March 29, 2024, 7:59 am

ভোজ্যতেলে মানুষের নাভিশ্বাস

ভোজ্যতেলের চড়া মূল্যে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। তেল নিয়ে তেলেসমাতি চলছেই। দেশের একশ্রেণির অসৎ মুনাফাখোর মজুতদারের কারসাজি ও বেশি লাভের আশায় প্রচুর পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুত করে রাখার ফলে দেশে সয়াবিন তেলের বাজারে চরম অস্তিরতা বিরাজ করছে।
সরকার বলছে দেশের মানুষের নাকি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে খেটে খাওয়া মানুষ ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা তাদের পরিবারের ব্যয় মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে। দেশে তেলের সংকট আছে সত্য। তাই বলে শুধু অতিমুনাফার লোভে যারা ভোজ্যতেল মজুত করে রেখেছে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে হলেও তাদের দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির আওতায় আনা না গেলে মজুতদারদের দৌরাত্ম্য আরও বাড়বে।
সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় অসাধু কারবারিদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। তাদের অসাধু কারসাজি থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে হবে। আর তা করতে হবে এখনই।
বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ হিসেবে জানা যায় যে, তেল উৎপাদনকারী দেশের তালিকার শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে দুটি দেশ হলো রাশিয়া এবং ইউক্রেন। এই খাত থেকে তাদের রপ্তানি আয় যথাক্রমে ৩০১ মার্কিন ডলার এবং ২২৪ মার্কিন ডলার। যুদ্ধের কারণে বর্তমানে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে সয়াবিন তেল রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ। সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম হলো ইউক্রেন আর দ্বিতীয় হলো রাশিয়া। তাদের বার্ষিক গড় উৎপাদন যথাক্রমে ৪৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ৪১ লাখ মেট্রিক টন। ইউক্রেন তার উৎপাদনের ৮৮ শতাংশ রপ্তানি করে আর রাশিয়া রপ্তানি করে প্রায় ৮৫ শতাংশ।
বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাদের রপ্তানি প্রায় শতভাগ বন্ধ। সরিষা বীজ বা সরিষা তেল উৎপাদনে নেপাল বিশ্বে প্রথম হলেও পরের দুটি দেশ হলো রাশিয়া ও ইউক্রেন। এই দুটি দেশ তাদের মোট সরিষা তেল বা বীজ উৎপাদনের প্রায় ৯৩ শতাংই রপ্তানি করে। যুদ্ধের কারণে সেটাও পুরোপুরি বন্ধ।
পাম তেল বা ভেজিটেবল অয়েল উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম ইন্দোনেশিয়া এবং দ্বিতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া। তাদের বার্ষিক গড় উৎপাদন যথাক্রমে ২৪.৫ কোটি মেট্রিক টন এবং ৯.৯ কোটি মেট্রিক টন। ইন্দোনেশিয়া তাদের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক রপ্তানি করে। মার্চ ২০২২ এর শেষ সপ্তাহ থেকে তারা পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। মালয়েশিয়াও রপ্তানি বন্ধের পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। বাংলাদেশ ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করেছিল। বাংলাদেশে উৎপাদিত সব প্রকার তেলবীজ থেকে প্রাপ্ত তেল দিয়ে দেশে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশও পূরণ হয় না। মোট চাহিদার ৯০ ভাগই আমদানি করতে হয়।
এখানে নির্মম সত্যটা হলো রাশিয়া- ইউক্রেন- ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের কারণে সারা পৃথিবীতে ভোজ্যতেল জোগানে ব্যাপক বিঘœ ঘটেছে। ফলে টাকা থাকলেও বাংলাদেশ তেল কিনতে পারছে না, বেশি দাম দিয়ে হলেও না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ যদি আরও দীর্ঘায়িত হয় তা হলে এ সংকট দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
বিশ্বে ভোজ্যতেল উৎপাদনের আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো আর্জেন্টিনা। তারাও তাদের উৎপাদিত তেল রপ্তানি সীমিত করবে বলে চিন্তাভাবনা করছে। যদি সেটা সত্য হয় তাহলে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট আরও চরম আকার ধারণ করবে।
সুতরাং এই পরিস্থিতিতে দেশেই তেলবীজ তৈরিতে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। আগামী মৌসুমে বেশি করে তেলবীজ চাষ করার জন্য কৃষি বিভাগকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশে সরিষা ও সূর্যমুখীর চাষাবাদ বৃদ্ধি করা না গেলে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরশীলতা থেকে বের হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত দুই বছরে ভোজ্যতেলের বাজার মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। এ ছাড়া মহামারি করোনার কারণে উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এমন অস্থিরতার কারণে গত দুই বছরে অন্তত একাধিকবার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। মূলত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। তুলনামূলক কম দামের কারণে দেশে সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে পাম অয়েল ব্যবহৃত হয়।
ভোজ্যতেল ছাড়াও খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পাম ওয়েল ব্যবহার হয়ে আসছে। এর মূল উৎপাদক দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। সেখান থেকেই এই তেল আমদানি করা হয়। আগেই বলেছি, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। ফলে প্রতি বছর আমাদের ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ কয়েক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয় মেটাতে হয়। অথচ সরিষার তেল হতে পারতো অন্যতম বিকল্প ভোজ্যতেলের উৎস।
দেশে সরিষার চাষাবাদ জনপ্রিয় করার জন্য কৃষক পর্যায়ে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করা গেলে কৃষকরা একদিকে যেমন লাভবান হতো অন্যদিকে সরিষা চাষে কৃষকরা উৎসাহিত বোধ করতো। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরশীলতা কমানো যেত। এ ছাড়া আমাদের দেশে বহু অটো রাইস মিল রয়েছে। অটো রাইস ব্র্যান ব্যবহার করেও এক ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেল (রাইস ব্র্যান অয়েল) উৎপাদন করা যায়। আমরা আমদানি তেলের বিকল্প হিসেবে এ ধরনের তেল উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখতে পারেন। এ ছাড়া আমরা দেশে প্রচুর পরিমাণে সূর্যমুখী চাষাবাদ করে তা থেকেও তেল উৎপাদন করতে পারি। যেভাবেই হোক আমাদের ভোজ্যতেলের ওপর থেকে আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতেই হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছরে দেশে অন্তত ৯ দফায় ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। এতে টিসিবির ট্রাকে ভোক্তাদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, পথেঘাটে চাঁদাবাজি পণ্য উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আয়ের সাথে ব্যয় মেটাতে খেটে খাওয়া মানুষ হিমসিম খাচ্ছে। এর মধ্যেই যোগ হয়েছে একশ্রেণির অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর অনৈতিক মজুতদারি ও কারসাজি।
সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় অসাধু কারবারিদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। তাদের অসাধু কারসাজি থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে হবে। আর তা করতে হবে এখনই।

লেখক: প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী ,আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD