April 28, 2024, 9:53 pm

কোরবানির পশুর চামড়ার কারসাজি কি ঐতিহ্য হয়েই থাকবে

কোরবানির পশুর দাম প্রতি বছর বাড়লেও চামড়ার দাম বাড়ে না- এক কঠিন সত্য। এর একটা চেইন আছে। কোরবানির চামড়া বাসাবাড়ি থেকে কিনে নেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা সেটি বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। আর পাইকাররা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করে তা বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে তা প্রতি বছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদিও এ প্রক্রিয়া গত কয়েক বছর ধরে অনেক জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জায়গায় এখন মাদরাসার ছাত্ররা বিনামূল্যে বা সামান্য দামে চামড়া নিয়ে আবার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছেই বিক্রি করে। তার মানে এখানে কয়েক হাত ঘুরে যে দাম হবে সেটি নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ যারা কোরবানি দেন তাদেরকে চামড়া বিক্রি করতে হয় সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কমে। এর পরও এবার কোরবানির কাঁচা চামড়ার বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থা হয়েও আর হলো না।

এবারকার ঈদুল আজহা এসেছে এমন প্রেক্ষাপটে যখন নানামুখী সঙ্কটে মানুষের অবস্থা ভীষণ খারাপ। গত বছরগুলোতে করোনার ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব শেষ না হতেই এক ভয়ঙ্কর মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে দেশ।

সর্বোপরি কোরবানির প্রাণীর চামড়ার মূল্যটার পুরোটা গরিব মানুষদের হক। গত ক’বছরে চামড়ার দামের বিপর্যয়ের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। গরুর চামড়া এক-দু-শ’ টাকায়ও বিক্রি করতে পারেনি বহু মানুষ। ছাগলের চামড়া বিক্রির তো প্রশ্নই আসেনি। অবিক্রীত অবস্থায় পচতে শুরু করা কয়েক লাখ চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। সম্পদের এক অকল্পনীয় অপচয় হয়েছিল সেই সময়। সবচেয়ে বড়কথা ‘গরিবের হক’, চামড়া বিক্রির টাকা পৌঁছেনি গরিব মানুষের কাছে। ওই ৩-৪ বছর কত টাকা কম গিয়েছিল গরিব মানুষের কাছে?

আর তাই গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারের দিক থেকে হুমকি-ধমকিসহ চেষ্টা ছিল। সরকার এ বছর তিন টাকা বাড়িয়ে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও ঢাকা বাইরে তা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করেছে। টাকার অঙ্কে তা সামান্য হলেও এর মাঝে সরকারের কিছুটা চেষ্টার নমুনা মেলে। কিন্তু আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ‘কেওয়াজ’ এবারও পিছু ছাড়েনি। তার ওপর বৃষ্টি কিছুটা গোলমাল পাকিয়েছে। এটি অজুহাত হিসেবে কাজে দিয়েছে। নিজেদের মধ্যে হিসাবের গণ্ডগোল থাকলেও বৃষ্টিতে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে দাবিতে আড়তদার-পাইকার-মৌসুমি ব্যবসায়ী সবাই একমত।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দাম না পাওয়ার অভিযোগ করলেও আড়তদাররা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনছেন তারা। রাজধানীতে চামড়ার প্রধান বাজার পোস্তায় প্রতি পিস গরুর চামড়া কমবেশি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঈদের দু-তিন দিন আগ থেকেই এবার চামড়ার বিষয়ে ধমকাচ্ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। হুমকিতে বলেছিলেন, সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ঠকালে, কাঁচা চামড়া রফতানির উদ্যোগ নেয়া হবে। মন্ত্রী বা সরকারি মহলের এ ধরনের গর্জন দৃষ্টে বর্ষণ হয় না কখনো।

এবার বছরের ব্যবধানে দেশে খোলা লবণের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ যা ঈদে পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল মালিকরা কারসাজি করে লবণের দাম বাড়িয়েছে। একই সাথে ট্যানারি মালিকদের বকেয়া থাকায় ক্ষোভ আছে তাদের। আর লবণ মালিক সমিতি বলছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের অতি মুনাফার করেণেই দাম বেড়েছে পণ্যটির। কোরবানির সাথে পশুর সম্পৃক্ততা। আর পশুর চামড়া সংরক্ষণে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক লবণ। চামড়া টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত লবণের। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বছরে ২৪ লাখ মেট্রিক টন লবণের চাহিদা থাকলেও শুধু কোরবানির সময়ই এর চাহিদা থাকে ১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। দেশে এ বছর ৬২ বছরের রেকর্ড ভেঙে লবণের উৎপাদন হয়েছে ২২ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন। তবুও কেন লবণের সঙ্কট? কেন ৭০০ টাকার লবণ কিনতে হয়েছে ১৪০০ টাকায়? জবাব নেই প্রশ্নটির। মৌসুম শেষ হয়ে গেলে এ প্রশ্ন হারিয়ে যাবে।

চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ হলেও সেখানে রফতানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের সনদ এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিবেশ স্বীকৃতি সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনটিই নেই বাংলাদেশের। এ কারণে ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না। বর্তমানে কিছু চামড়া চীন, হংকং ও জাপানে রফতানি করা হয়। সেসব দেশেও চামড়ার চাহিদা অভ্যন্তরীণভাবে কমে গেছে। রফতানি কমার পেছনে দায় চাপানো হয় সরকারের ঘাড়ে। আড়তদার, পাইকার, ট্যানারি মালিকরা ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের চেয়ে শক্তিমান। সরকারের হুমকি-ধমকিকে তারা কেয়ার করেন না। কৃত্রিম চামড়া এবং প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারকে চামড়ার বাজার পড়ে যাওয়ার একটি বিশাল কারণ বলে প্রমাণের বহু তথ্য তাদের কাছে আছে।

নানা তথ্য, যুক্তির মাঝেও বাংলাদেশে চামড়া উৎপাদন আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত চামড়া শিল্প। তা এক দিকে দেশে বেশ কর্মসংস্থানের সুযোগ করেছে। এ শিল্প থেকে প্রতি বছর সরকারের কোষাগারেও জমা পড়ছে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশী চামড়ার মান অন্যান্য দেশের থেকে উন্নত হওয়ায় ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সে কারণে, দেশের অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলা যায়। কিন্তু তালগোল পাকিয়ে গোটা বিষয়টিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভিন্নদিকে।

চামড়ার বাজার-অর্থনীতীর বাইরে কোরবানির পশুর চামড়ার বিষয়টি একটু ভিন্ন। এ চামড়ার সাথে ধর্মের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোরবানির চামড়ার মধ্যে গরিবের হক রয়েছে বলে বিশ্বাস মুসলিমদের। গত বছর কয়েক এ হকটি নিয়ে এক অকল্পনীয় অপচয় ও নোংরামি চলে আসছে। দেশের চামড়া খাতে সংশ্লিষ্টরা যখন রফতানিকেই তাদের একমাত্র আয়ের পথ বলে দেখানোর চেষ্টা করেন তখন সাধারণ মানুষ অন্তত জানে কোটি কোটি মানুষ ভীষণ দারিদ্র্যে থেকে গেলেও বর্তমান বাংলাদেশে আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে অনেক মানুষের। একটার পর একটা নতুন চামড়ার ব্র্যান্ড বাজারে আসছে। আসছে প্রচুর ব্র্যান্ড ছাড়া চামড়ার জুতা-স্যান্ডেলও। বেশ কয়েক বছর থেকে এই দেশের অভ্যন্তরেই চামড়ার একটি বড় বাজার আছে। সুতরাং বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দেখিয়ে চামড়ার যাচ্ছেতাই মূল্য পতন ঘটানো একেবারেই অযৌক্তিক।

ঈদুল আজহা ঘনিয়ে এলেই চামড়াকে মূল্যহীন করে দেয়ার কোনো কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়। ২০১৯ সালে জানানো হয়, বাংলাদেশের ব্যবসা যেহেতু চীনের সাথে তাই আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীনে চামড়া পাঠানো অনেক কমে গেছে। চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এমনকি এই দাবিও করা হয়েছিল যে, অনেক কন্টেইনার চামড়া তারা চীনে পাঠাতেও পারেননি। এরপর দেয়া হয় করোনার দোহাই। করোনার কারণে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমে যাবার কথা বেশ ছড়ানো হয়।

এবার আগেভাগেই শোনানো হচ্ছিল চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় লবণসহ ৯২ ধরনের রাসায়নিকের অনেক মূল্যবৃদ্ধির কথা। ইউরোপে রফতানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন-আইএসও এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ-এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় ইউরোপে রফতানি করতে না পারার কথাও বাদ যায়নি। ফলে একমাত্র বাজার চীন, যেখানে দাম ভালো নেই। অর্থাৎ এ বছরও বুঝিয়ে দেয়া হয়, চামড়ার দামের কারসাজির আগাম বার্তা। গত কয়েক বছরে দেশের চামড়া ব্যবসা করা বড় আড়তদার কিংবা ট্যানারি মালিকরা যখন বারবার বলছিলেন, নানা বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশের চামড়ার চাহিদা বহির্বিশ্বে আর খুব একটা নেই, তখন খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে, তাহলে সরকার কেন পুরোপুরি প্রক্রিয়াজাতকরণের আগেই চামড়া রফতানি করার পদক্ষেপ নেয়নি? মজার ব্যাপার চামড়া ব্যবসায়ীরা যখন নানা রকম বৈশ্বিক পরিস্থিতি দেখিয়ে বিশ্বব্যাপী চামড়ার চাহিদা না থাকার কথা বলছেন, তখন প্রতি বছরের মতো এই বছরও বিজিবি সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল কাঁচা চামড়া পাচার ঠেকাতে। অর্থাৎ এটা নিশ্চিত, বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে ভারতে কাঁচা চামড়ার চাহিদা আছে। তাহলে কি ভারতে কাঁচা চামড়া পাচার হতে দেয়া উচিত ছিল?

ভারতে পাচার হওয়ার প্রবণতা আমাদের সামনে একটা জিনিস স্পষ্ট করে যে, এই দেশে চামড়া নিয়ে কারসাজি হচ্ছে প্রতি বছর। চামড়াশিল্প নগরীর পরিবেশগত মানের সমস্যা, চামড়া ব্যবসায়ীদের মূলধনের অভাব, আনুষঙ্গিক রাসায়নিকের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি যেসব অজুহাত দেখানো হয়, সেসব যাদের দেখার কথা দেখুক তারা। কিন্তু তারা আসলে দেখে না। কারণ এই শত শত কোটি টাকা যে লুট হয়, তার হিস্যা পায় সরকারের নানা মহল। যাদের হাতে সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল করার ক্ষমতা আছে, তারা এগুলো নিয়ে খুব বেশি গা করেন না। এতে চামড়ার কারসাজিটা সাঙ্গ হয়ে যায় কয়েক দিনে। এরপর আর কে মনে রাখে এসব কথা?

বাংলাদেশকে বিশ্বের দেশে-দেশে একটি নির্ভরযোগ্য রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে চামড়াশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের চামড়া রফতানির বাজার প্রতি বছর শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ হারে বাড়ছে এবং টাকার অঙ্কে যেটা বছরে গড়ে ৩০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এসব ইতিবাচক তথ্য আড়াল করে কেবল নেতিবাচকগুলো সামনে এনে চামড়াকে লোকসানের খাত প্রমাণের চেষ্টা স্পষ্ট, যা প্রকারান্তরে ঠকবাজি আর কারসাজির ঐতিহ্যকেই প্রতিষ্ঠিত করছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD