April 27, 2024, 7:43 pm

প্রসঙ্গ: তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
(প্রথম পর্ব)
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির ইতিহাস কাপুরষতা, শঠতা, সংবিধান লঙ্ঘন ও স্বার্থপরতার ইতিহাস তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দেশে বিতর্কের শেষ নেই। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার ধারণা উদ্ভাবনের পর থেকে, আজ পর্যন্ত নির্বাচনের সময়ে এটি প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন এবং তা নাকচ করার পালা অব্যাহতই রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির পক্ষে যুক্তি হলো, দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য Ñ এটি সংবিধানে নেই। দুর্ভাগ্যবশত চলমান এ বিতর্কের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক অনভিপ্রেত শঠতা, সংবিধান লঙ্ঘন, স্বার্থপরতা, এমনকি পেশাগত অসদাচারণ ও আদালতের সাথে প্রতারণার ঘটনা।

পাঠকদের স্মরণ আছে যে, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাদেশে যখন ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে, তখন ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তা নাকচ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজন করে সংসদ থেকে সম্পূর্ণ নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ করে বিএনপি। এরপর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংμান্ত উচ্চ আদালতের এক রায়ের প্রেক্ষিতে ২১ জুলাই ২০১০ তারিখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের অন্যান্য শরিকদের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে, যাঁদের আটজনই এখন প্রয়াত, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করার প্রস্তাব সংসদে অনুমোদিত হয়। বেগম সাজেদা চে․ধুরীকে চেয়ারপার্সন এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপার্সন করে ১৫ সদস্য নিয়ে উক্ত কমিটি গঠিত হয়। বিএনপিকে একজন সদস্যের নাম প্রস্তাবের জন্য বলা হলেও তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশের পর এটির ক্সবধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি মামলা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রথম মামলাটি করেন ক্সসয়দ মশিউর রহমান, যেটি বিচারপতি মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের বেঞ্চ খারিজ করে দেন। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় মামলাটি করেন সালিম উল্যা, যেটি নাকচ করে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন, বিচারপতি মো. আওলাদ আলী ও বিচারপতি মীর্জা হায়দার হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ রায় দেন। বাদীর আপিলের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ শুনানির পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১০ মে ২০১১ তারিখে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ‘প্রসকেটিভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করে একটি সংক্ষিপ্ত বিভক্ত আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিগণ। একইসঙ্গে আদালত μান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের, কোনোরূপ শর্ত ছাড়াই, ক্সবধতা প্রদান করেন। আদালত অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যস্থা থেকে বিচার বিভাগকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। অর্থাৎ আদালত তার সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জীবন্ত রেখে পরবর্তী দুই নির্বাচন এর অধীনে অনুষ্ঠানের নিঃশর্ত অনুমতি দেন।

এদিকে সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন ও অ‣বধভাবে ক্ষমতা দখল রোধের লক্ষ্যে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হলেও, কমিটি পুরো সংবিধানকে পর্যালোচনা করে তা সংশোধনের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। দশ মাসের মেয়াদকালে কমিটি ২৬টি ক্সবঠক করে এবং ১০৪ জন বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনীতিবিদদের পরামর্শ গ্রহণ করে ২৯ মে ২০১১ তারিখে তিন মাসের সময়সীমা বেঁ ধে দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক
সরকার রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত সুপারিশ প্রস্তুত করে। তবে পরদিন নির্বাহী বিভাগের প্রধান Ñ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে Ñ সাক্ষাতের পর কমিটির সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়, যা ছিল ‘সেপারেশন অব পাওয়ারস’ বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির নগ্ন লঙ্ঘন। কিন্তু কমিটির কোনো সদস্য এর প্রতিবাদও করেননি। বরং ৮ জুন ২০১১
তারিখে স্পিকারের কাছে প্রেরিত প্রতিবেদনে কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে এবং সংসদ বহাল রেখেই সংবিধান সংশোধনের চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করে, যার ভিত্তিতে ৩০ জুন তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে সংসদে পাশ হয়, যদিও সংবিধান ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’। উচ্চ আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যস্থাকে ভবিষ্যতের জন্য অ‣বধ ঘোষণার ১৯ দিন পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য রেখেই সংবিধান
সংশোধনের বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ এবং পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তা পাল্টে যাওয়া এবং একমাসের মধ্যে, ৩০ জুন ২০১১ তারিখে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ ছিল চরম নাটকীয়তার মাধ্যমে গৃহীত এক প্রলয়ঙ্করী সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের বিধ্বংসী প্রভাবে পরপর দুটি ব্যর্থ নির্বাচন আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয়, যা আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ধ্বংস করে জাতিকে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে।

উল্লেখ্য যে, বিশেষ সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন Ñ অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে Ñ প্রধানমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন: ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আমি বাতিল করিনি। আদালত বাতিল করেছেন…আইনের শাসন মানলে আদালতের রায় মেনে চলতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে জড়িত করা যাবে না’ (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১)। প্রধানমন্ত্রীর এ
বক্তব্য সঠিক নয়, কারণ পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আদালত তার ১০ মে ২০১১ তারিখে সংক্ষিপ্ত আদশে সংসদের অনুমতির কোনো শর্ত দেননি। অর্থাৎ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে, যে বন্দুকের গুলি জনগণের হৃদয় বিদীর্ণ করে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণপ্রদীপকেই যেন নিভিয়ে দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিশেষ সংসদীয় কমিটি ৮ জুন তারিখে স্পিকারের কাছে প্রেরিত প্রতিবেদনে আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যটিরই পুনরাবৃত্তি করে, যদিও কমিটির ১৬ মে ২০১১ তারিখের ২৪তম ক্সবঠকের কার্যবিবরণী থেকে এটি সুস্পষ্ট যে এর সদস্যগণ জানতেন যে, উচ্চ আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শর্তহীনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছেন। উপরিউক্ত ক্সবঠকে কমিটির সদস্য-সচিবের এ সম্পর্কিত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমার সামনে কোনো বিকল্প নেই। আমাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে।’
আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে, পরবর্তী দুই নির্বাচনের জন্য এটিকে জীবিত রাখা, সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের মতে, সংসদের কাজে আদালতের হস্তক্ষেপের শামিল, যা সংবিধানের ক্ষমতার  পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। লক্ষণীয় যে, এ ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হকের একটি স্বার্থ জড়িত ছিল Ñ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তিনিই হতেন এর প্রধান উপদেষ্টা। একইভাবে আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশের অপব্যাখ্যার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ছিল ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও একটি স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। কারণ এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নিজের নেতৃত্বে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান পুনঃপ্রবর্তিত হয়। আর দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া অতীতের সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরাই ক্ষমতায় টিকে ছিল।  ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় ১৬ সেপ্টেম্বের ২০১২ তারিখে রায় নিয়ে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণের পেশাগত অসদাচারণের অভিযোগও ওঠেছে। বিচারকগণ তাঁদের সংক্ষিপ্ত আদেশে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিঃশর্তভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের অনুমতি দিলেও, পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধানমন্ত্রীর অপব্যাখ্যার অনুকরণে সংসদের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেন। নতুন কোনো শুনানি ছাড়া রায়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ন্যায়বিচারের পরিপন্থি এবং ‘ফ্রড অন দ্য কোর্ট’ বা আদালতের সাথে প্রতারণার শামিল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্যায় ও অন্যায্যভাবে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, শঠতার আশ্রয় নিয়ে, ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থে।

(দ্বিতীয় পর্ব)
তত্ত্বাবধায়ক সংμান্ত সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ ভণ্ডুলের নেপথ্যে  পাঠকদের স্মরণ আছে যে, ১০ মে ২০১১ তারিখে একটি সংক্ষিপ্ত বিভক্ত আদেশের মাধ্যমে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ক্সবধতা দিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের এয়োদশ সংশোধনীকে ‘প্রসপেকটিভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। এর ১৯ দিন পর, ২৯ মে ২০১১ তারিখে, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এবং ক্সবদেশিক চুক্তি করার করার ব্যাপারে কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত সুপারিশ করে। কমিটির সদস্যদের বক্তব্যে তাঁদের
সর্বসম্মত এ সিদ্ধান্তের যে․ক্তিকতা উঠে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২৯ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত কমিটির ১৪তম সভায় মাননীয় সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন: ‘আমার
ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেজর কোনো কিছুতে হাত দেওয়া আমাদের কোনো মতেই উচিত হবে না। আমাদের আরেকটি ইস্যু ক্সতরি করা ঠিক হবে না…মাননীয় সদস্য জনাব আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সাহেব যে কথা বলেছেন আমি তাঁর সাথে পুরোপুরি একমত পোষণ করছি…আমরা সংসদে একটা বিল আনব। আমরা যা-ই আনি না কেন, সেটার একটা বিরোধিতা হবে। কখনো একটা মিমাংসিত বিষয়কে অমিমাংসিত করাটা ঠিক হবে না…যতই গভীর রাতে এই (ত্রয়োদশ) সংশোধনী আনুক না কেন, একা আনুক না কেন, কতগুলো জিনিস আমরা মেনে গেছি। তাই এখন বিচার বিভাগ থেকে এটাকে সরিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না, প্রতিরক্ষা বিভাগ সরিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না…যদি দুই টার্মের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয় তা হলে দেখা যাবে যে, ওই দুই টার্মের পর হয়তো আমাদেরকে ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। তখন আমাদের চিৎকার করতে হবে। সুতরাং দুটি মেয়াদ অর্থাৎ পরবর্তী নির্বাচন) এবং তারপরের নির্বাচন। তারপর আর এটা থাকবে না। এই সময় এর মধ্যে আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে না…আমরাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রণেতা, আমরাই এর স্রষ্টা। আমাদেরটাকে দুই মেয়াদ, তিন মেয়াদ করে শেষ করতে চাই কেন? কোন কিছুই স্থায়ী নয়। সেজন্য আমি মনে করি, সব জায়গায় আমাদের হাত দেওয়া উচিত না।’

আমির হোসেন আমু বলেন: ‘আসলে আমরা যদি এটা পরিবর্তন করতে যাই, তাহলে অনেক জটিলতা সৃষ্টি করবে, অনেক ঝামেলার মধ্যে আমরা জড়িয়ে পড়বো। তার চেয়ে ভাল এটা যেভাবে আছে, সেভাবে থাক। তবে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর একটা কথা বলেছেন যে, তিনমাস সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া।’ আবদুল মতিন খসরু বলেন: ‘আমরা যখন প্রথম ক্সবঠকে বসি, তখন কতগুলো নীতিমালা আমরা নিয়েছিলাম যে, আমরা এমন কোনো বিষয়ে যাব না, যাতে বিতর্কে জড়িয়ে যাই। আমরা বিতর্কিত কোনো বিষয়ে হাত দেব না। এ প্রস্তাবটা মাননীয় সদস্য তোফায়েল আহমেদ আজ থেকে পাঁচ ক্সবঠক আগে দিয়েছিলেন। আমরা সকলেই তার সাথে একমত। আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ব্যবস্থা আছে, এটিই থাকুক। এর মধ্যে আমাদের হাত দেওয়া ঠিক হবে না। এতে জটিলতা আরও বাড়বে। বিরোধী দলকে আমরা আরেকটা সুযোগ দেব কথা বলার জন্য; আমাদের ঘায়েল করার জন্য…দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার মতো অবস্থা বাংলাদেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি।’ রাশেদ খান মেনন আবদুল মতিন খসরুর বক্তব্যের সূত্র ধরে বলেন: ‘মাননীয় সদস্য, আপনি যেটা বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বিতর্কিত বিষয়ে যদি না যাওয়া যায়, তাহলে তো কোনো বিষয়েই আমরা যেতে পারব না।’

হাসানুল হক ইনু বলেন: ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখন যে বিধান আছে সেখানে তার ‘মেয়াদ’টি সুনির্দিষ্ট নয়। সে মেয়াদ সুনির্দিষ্ট থাকা দরকার … কেয়ারটেকার সরকারের বিধান রাখার পক্ষেই আমরা সবাই একমত। বর্তমানে কেয়ারটেকার সরকারের বিধানে যেটুকু ত্রুটি বিচ্যুতি আছে সেগুলো সংশোধন করবো, এ ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যে এসেছি।’

ড. শিরিন শারমিন চে․ধুরী বলেন: ‘আমিও একমত যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আমাদের কোনো পরিবর্তন এ মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। যদি সময়টা সীমিত করার বিষয় থাকে, তাহলে সে ব্যাপারে হয়তো আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
প্রবীন রাজনীতিবিদ মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন: ‘দেশের রাজ‣নতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থাই (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) শ্রেয়।’

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন: ‘আমি ২টি টার্ম বলেছি দুটি কারণে। এবার কোনো বিতর্ক হবে না কেন? আপনার ইস্যু হচ্ছে ইলেকশন। বিএনপিও বলতে পারবে না যে তারা স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখবে। আর আমি তো আজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উঠিয়ে দিচ্ছি না। আমি তো বলছি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে ইলেকশন করতে চাই। আমি তো আরও একটি ইলকেশন করব কেয়ার টেকার সরকার দিয়ে। সুতরাং এটাতো এখন একটা ইমিডিয়েট ইস্যু হতে পারে না।’

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন: ‘৯০ দিন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের থাকার যে বিধান বর্তমানে সংবিধানে রয়েছে, সেটি স্পষ্ট নয়। এটি স্পষ্ট করতে হবে। পার্লামেন্ট ভেঙে যাবার ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে এবং কেয়ার-টেকার সরকার নব্বই দিনের বেশি কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারবে না…তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারেও আমাদের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এটি সংবিধানে সারা জীবন থাকবে কিনা, আরো ২/১ টার্ম থাকবে কিনা। এ বিষয়গুলোও থাকবে। অনুচ্ছেদ ১২, ৩৮ তারপর ৫৯ বিভিন্ন বিষয়গুলো আমাদের মনে হয় বসে দেখা দরকার।’

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন: সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এটাকে রেখেই আগানো ভালো। এটার উপরেই একটি ঐকমত্যে আমরা যাই। তারপরে ছিদ্রপথগুলোতে যাব।” আর এ দুর্বলতাগুলো দূর করতেই তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এবং ক্সবদেশিক চুক্তি করার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে সংসদীয় বিশেষ কমিটি তার ২৯ মে ২০১১ তারিখের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত সুপারিশ করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের দশম ও একদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সংক্ষিপ্ত আদেশের পরও এটি সংশোধিত আকারে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেখে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির ২৯ মে ২০১১ তারিখের সর্বসম্মত সুপারিশ ছিল অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, যিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান, সাক্ষাতের পর কমিটির সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়, যা ছিল সংবিধানের ‘সেপারেশন অব পাওয়ার্স’ বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির নগ্ন লঙ্ঘন। কিন্তু কমিটির কোনো সদস্যই এর প্রতিবাদ করেননি। বরং কমিটির কো-চেয়ারপার্সন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি। আওয়ামী লীগের নীতি ও সিদ্ধান্তই আমার নীতি ও সিদ্ধান্ত। শেখ হাসিনা আমার নেত্রী। এর বাইরে কিছু নেই’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১ জুলাই ২০১১)।

এটি সুস্পষ্ট যে, কমিটির সদস্যদের অনেকেই ছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্র, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের কেউ-ই আমাদের ইতিহাসের নায়ক হতে পারেননি। ইতিহাসের নায়ক হওয়ার জন্য যে ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতা প্রয়োজন, তাঁদের কেউই চূড়ান্ত বিবেচনায় তা দেখাতে পারেননি। ক্ষমতা, মর্যাদা, সম্পদ ও প্রতিপত্তির মোহ থেকে ব্যক্তি হিসেবে তাঁরা মুক্ত হতে পারেননি। তাঁরা শীর্ষ নেতৃত্বের ভয়কে জয় করতে পারেননি, বরং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রত্ব, স্বার্থপরতা ও কাপুরুষতার কাছেই তাঁরা পরাজিত হয়েছেন। তাঁদের এ পরাজয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকেই অন্ধকারের চোরাগলিতে ঠেলে দিয়েছে।

(তৃতীয় পর্ব)
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদদের মতামত উপেক্ষিত সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ‘প্রসপেকটিভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণার ১০ মে ২০১১ তারিখের সংক্ষিপ্ত আদেশ সত্ত্বেও, তিন মাসের সময়
বেঁধে দিয়ে অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি ২৯ মে ২০১১ তারিখের সর্বসম্মত সুপারিশ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ সুপারিশে পেঁ․ছাতে কমিটি মোট ১০৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করেন। এসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ক্সদনিক পত্রিকার সম্পাদক ও সেক্টর
কমান্ডার্স ফোরামের সদস্য।

উদাহরণস্বরূপ, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কমিটির সদস্যদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সং¯‥ার করতে হবে, যাতে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন শেষ করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘…অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক সরকার আর কেউ দেখতে চায় না…তাই ৫৮ অনুচ্ছেদকে একটু সংশোধন করে ঐ সুযোগটা যাতে আর না থাকে (তা) বন্ধ করে একটি টাইম ফ্রেম দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন…একটা সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং এই সময়ের মধ্যে যদি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অব্যবহিত পূর্বের সরকার এসে নির্বাচন দেবে…(এই) মতামতটিও নিতে পারেন যে, পার্লামেন্টে সরকার দল, বিরোধী দল যারা আছেন তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করে সকলের মতামতের ভিত্তিতে একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং দশজন উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজন বলে আখ্যায়িত করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করার পরামর্শ দেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবশ্যক বলে মত দেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল
রফিক-উল-হকের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখতে হবে। এটা যতই খারাপ হোক, এটা না রাখলে অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নীতিগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সমর্থন করেন।

জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট ড. কামাল হোসেন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হলো সেনা শাসন। আজমালুল হোসেনের কিউসির মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নির্বাচন করে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে যাবে। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি রাখা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন, তাঁর মন্ত্রিসভা নির্ধারণ ইত্যাদি কার্যμমের জন্য প্রয়োজনীয় সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করেন। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি অভিজ্ঞতার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে পরিমার্জিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমরা রাখব। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুল জলিল এমপি প্রধান উপদেষ্টার পদ সংসদে নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর মতামত নিয়ে নিষ্পত্তি করার প্রস্তাব করেন এবং বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানান। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এখনও প্রয়োজন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক বলেন, সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি বর্তমান রাজ‣নতিক বাস্তবতার আলোকে বহাল রাখা যেতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে এর আওতা থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তাই এটি থাকতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজ‣নতিক সমঝোতার ফসল। আমাদের বড় রাজ‣নতিক দলগুলো সমঝোতার মাধ্যমে এটি মেনে নিয়েছে। তাই সংবিধান সংশোধন করে এর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বড় রাজ‣নতিক দলগুলো যদি ঐকমত্যে পেঁ․ছতে না পারে, তাহলে এর সংশোধন করে যা লাভ হবে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে একটি গোঁজামিল বলে আখ্যায়িত করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করার দায়িত্ব করে ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর গুরুত্ব দেন।

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়েজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক সময় আমাদের ধারণা হয়েছিল যে, পরপর কয়েকটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়ে গেলে, তখন দেশের সাধারণ ভোটার অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং তখন এর প্রয়োজনীয়তা আপনা থেকেই চলে যাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে, এখনও সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে এর জন্য একটি সময় বেঁধে দেওয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়সীমা হওয়া উচিত তিন মাস। এই তিন মাস সময়সীমার মধ্যে যদি নির্বাচন সম্পন্ন করতে এটি ব্যর্থ হলে সংবিধানে স্পিকারকে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ক্সসয়দ শামসুল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি যদিও আমাদের দরকার ছিল, কিন্তু এটা বহাল রাখার ব্যাপারে আমাদের ভেবে দেখবার আছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক এ বি এম মূসা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার দরকার নেই। এটা যেমনি আছে তেমনই থাকুক। লেখক ও গবেষক ক্সসয়দ আবুল মকসুদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্কিত কোন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে পরবর্তীতে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পার্লামেন্টে এসে এটি রদবদলের সুযোগ পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রেসিডেন্ট এককভাবে ক্ষমতাশালী ছিলেন দেখে আর্মিরা গত আমলে অনেক কিছু করতে পেরেছে। আপনারা একটি বিধান করুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যিনি প্রধান থাকবেন, যেমন প্রেসিডেন্ট, তাকে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের পরামর্শে কাজ করতে হবে। এই বিধানটি যেন অবশ্যই সংযোজন করা হয়।

বর্তমান নিবন্ধের লেখক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের রাজ‣নতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের ফসল…তাই আমার প্রস্তাব হবে, আগামী দুই মেয়াদের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তিকরণ। এ সময়ের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য হতে হবে নির্বাচন প্রμিয়া, নির্বাচন কমিশন, রাজ‣নতিক দল ও নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বিধানসহ আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সং¯‥ার।

এছাড়াও ক্সদনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, ক্সদনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ক্সদনিক কালের কন্ঠের সম্পাদক আবেদ খান, ক্সদনিক নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, দৈনিক বাংলাদশ প্রতিদিনের সম্পাদক শাহজাহান সরদার, দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং দৈনিক সমকাল এর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার কমিটির সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে কমিটির সামনে বক্তব্য
রাখেন। উদাহরণস্বরূপ, শ্যামল দত্ত বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনই তো আমরা মানি না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কীভাবে মানব। ফলে আমি মনে করি রাজ‣নতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এমন কোনো জায়গায় পেঁ․ছেনি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে বিশেষ সংসদীয় কমিটি নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য রেখেই সংবিধান সংশোধনের জন্য সর্বসম্মত সুপারিশ করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর, যিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান, হস্তক্ষেপে কমিটি তার সুপারিশ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়েই ‘মেজরেটারিয়ান’ পদ্ধতিতে বা একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করা হয়, যার বিধ্বংসী প্রভাব আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

(চতুর্থ পর্ব)
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলে উচ্চ আদালতের কলঙ্কজনক রায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলসমুহের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এটির ক্সবধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ হাইকোর্টে দুটি মামলা হয়, যেগুলো আদালত খাারিজ করে দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রেক্ষিতে ১০ মে ২০১১ আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ চারজন বিচারপতি এক সংক্ষিপ্ত আদেশে μান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শর্তহীনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার অনুমতি দিয়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। এর ১৯ দিন পর ৯০ দিনের মধ্যে মেয়াদ সীমিত করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই সর্বসম্মতভাবে একটি সুপারিশ প্রণয়ন করে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি। এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ভবিষ্যতের জন্য অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাঁর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এই রায়ের সঙ্গে অন্য তিনজন বিচারপতি Ñ বিচারপতি মো. মোজাম্মেল
হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি ক্সসয়দ মাহমুদ হোসেন Ñ একমত পোষণ করেন। সেই রায়ে সংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী দুই মেয়াদের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা ২০১১ সালের ১০ মে তারিখের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। প্রসঙ্গত, আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী সংখ্যাগরিষ্ঠ চারজন বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধান সম্মত বলে রায় দেন। আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের রায়ের যে․ক্তিকতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের রাজ‣নতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়েই যেন চারজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে এক ধরনের ঠুনকো, সস্তা আবেগের বশবর্তী হয়ে, সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর যুক্তির ভিত্তিতে, তাঁদের সংক্ষিপ্ত আদেশ ও পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রদান করেছেন। তাঁরা বিবেচনায়ই নেননি যে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল এবং একটি রাজ‣নতিক ঐকমত্যের প্রতিফলন। এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। আরও বিবেচনায় নেননি যে, যেহেতু সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয়, তাই সংবিধানের মে․লিক কাঠামো হিসেবে গণতান্ত্রিক শাসন আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য। এছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জনগণের সার্বভে․মত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়, কারণ সার্বভে․ম জনগণ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক আর তাদের সঠিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সে ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। উপরন্তু আদালত বিবেচনায় নেননি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি ছিল
ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিগণ আরও আমলে নেননি যে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষদের বিবেচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এটি সুস্পষ্ট যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা উপেক্ষা করেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ তাঁদের রায় দিয়েছেন। আর তা করতে গিয়ে তাঁরা আইনের ‘পলিটিকাল কোয়েশ্চান’ বা রাজ‣নতিক বিষয় নামক প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বটি উপেক্ষা করেছেন। এ তত্ত্বের পেছনে যে․ক্তিকতা হলো যে, রাজনীতিবিদদেরই দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনা করা, তাই তাদের রাজ‣নতিক সিদ্ধান্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে বেআইনি না হলে, তাতে আদালতের হস্তক্ষেপ করা সঠিক নয়।
লক্ষণীয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ তাঁদের সংক্ষিপ্ত আদেশের প্রায় ১৬ মাস পরে চূড়ান্ত রায় প্রদানকালে বিবেচনায়ও নেননি যে, তাঁদের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদানের পরেও, বিশেষ সংসদীয় কমিটির সদস্যগণ, তাঁদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অপরিহার্য মনে করে পরিবর্তিতরূপে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বহাল রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত সুপারিশ করেন। এ সুপারিশটি প্রণীত হয়েছে বিশেষজ্ঞসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ১০৪ জন নাগরিকের মতামত নিয়ে এবং নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে। বিচারপতিদের পক্ষ থেকে রাজনীতিবিদদের অভিজ্ঞতালব্ধ এ সুপারিশটি আমলে নেওয়াই কাম্য ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ তাঁদের ‘আইভরি টাওয়ারে’র অবস্থান থেকে তা যেন উপলব্ধিই করতে পারেননি। আরও লক্ষণীয় যে, একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নাকচ করে দেওয়া ছিল আমাদের সংবিধানের ‘সেপারেশন অব পাওয়ার্স’ বা ক্ষমতার পৃথকীকরণের নীতির লঙ্ঘন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আদালত বাতিল করেছেন…আইনের শাসন মানলে আদালতের রায় মেনে চলতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসতে পারে’ (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১)। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য ছিল বিভ্রান্তিকর, কারণ আদালত তার সংক্ষিপ্ত আদেশে নিঃশর্তভাবে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাই পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রদানের আগে একটি সংসদীয় কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর বাতিল করে দেওয়ার এখতিয়ারের
বিষয়টি আপিল বিভাগের খতিয়ে দেখা উচিত ছিল। আরও উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যাখ্যার বিষয়টির ব্যাখ্যা দাবি করা Ñ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কারণ এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের পরিবর্তে তাঁর নিজের নেতৃত্বে গঠিত দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি অ্যামিকাস কিউরিদের বিশেষজ্ঞ মতামত এবং প্রজ্ঞাও উপেক্ষা করেছেন। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর নিজের রায়ে বলেছিলেন, ‘তাঁহাদের আশঙ্কা নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনপুস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশঙ্কা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর যুক্তির ভিত্তিতে, অতি উৎসাহী হয়ে,
বিচারপতিগণ তাঁদের এ আকুতি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণার বলে রায় দেওয়ার পেছনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ যুক্তি দেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের আগ পর্যন্ত ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করে সংসদ বিলুপ্ত করে আমাদের দেশে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হত, যে সরকারের সদস্যরাও, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অনির্বাচিত। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদ্যস্যরা অনির্বাচিত হলে, বিলুপ্ত সংসদের সদস্যদেরকে কীভাবে নির্বাচিত বলা যায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

অন্যদিক থেকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলা অযে․ক্তিক। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা, তাই তাদেরকে রাজতন্ত্র বলা হয়, যদিও তাদের পুরো রাষ্ট্র কাঠামোই গণতান্ত্রিক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত, যদিও পরোক্ষভাবে এবং আমাদের দেশে সকল রাষ্ট্রীয় কার্যμম পরিচালিত হয় রাষ্ট্রপতির নামে, তাই বাংলাদেশকে অগণতান্ত্রিক বলা কোনোভাবেই যে․ক্তিক নয়।

লক্ষণীয়, বিচারপতি খায়রুল হকের লিখিত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও এটিকে পরবর্তী দুই নির্বাচনের জন্য জীবন্ত রাখা হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের মতে এটি আদালতের পক্ষ থেকে সংসদের কাজে হস্তক্ষেপ, যা ক্ষমতার পৃথকীকরণের নীতির লঙ্ঘন। এভাবে সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিচারপতি খায়রুল হকের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, ফলে এ সিদ্ধান্তটি স্বার্থপ্রণোদিত ছিল কিনা সে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক, প্রধানমন্ত্রীর অনু করণে, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংসদেও অনুমতির শর্তটি জুড়ে দেন, যা ছিল ‘ফ্রড অন দ্য কোর্ট’ বা আদালতের সঙ্গে প্রতারণা, এমনকি বিচারকের পেশাগত অসদাচারণ। তাই আমরা মনে করি যে, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংμান্ত আপিল বিভাগের রায়টি একটি চরম কলঙ্কজনক, কারণ এটি ছিল সম্পূর্ণ অন্যায্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিভ্রান্তিকর যুক্তিপ্রসূত এবং সংবিধানের পরিপন্থি, যা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD