March 29, 2024, 10:41 am

জুলফিকার আলি ভূট্রো ও কিছু কথা।

প্রিয়জনরা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জুলফি নামেই ডাকতেন। ১৯৫৪-এর একদিন বন্ধু আকবর বুগতিকে অভ্যর্থনা জানাতে করাচি এয়ারপোর্ট এসেছেন আগামী দিনের বালুচ নেতা শেরবাজ খান মাজারি। তার চোখ পড়ল হুইলচেয়ারে বসা এক বৃদ্ধকে ঠেলে সামনে এগোচ্ছেন এ সুদর্শন তরুণ; কয়েক মুহূর্ত পরই সেই তরুণ এসে বললেন, তিনি যদি শেরবাজ খান হয়ে থাকেন, তাহলে তার পিতাজি তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন হুইলচেয়ারে বসা মানুষটি স্যার শাহ নওয়াজ ভুট্টো। চিকিৎসার জন্য ছেলে জুলফিকে নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন। ফেরামাত্রই স্যার শাহ নওয়াজ শেরবাজকে ডিনারে ডাকবেন, তাকে আসতেই হবে। এ কথাই তিনি বললেন। সত্যিই তিনি কয়েক দিন পর জুলফির ফোন পেলেন। তার বাবা খেতে ও গল্প করতে ডেকেছেন। গল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে তিনি যেন জুলফিকে ঠিকভাবে গাইড করেন। শেরবাজ খান সে সুযোগ পাননি। ভুট্টো তার পরামর্শ শোনার জন্য জন্মগ্রহণ করেননি। ভুট্টোর শাসনকালে তার কেটেছে জেলখানায়, ভুট্টোর ইঙ্গিতে দায়ের করা মামলা-মোকদ্দমায়। এসব কাহিনীর জন্য শেরবাজ খান মাজারির ‘এ জার্নি টু ডিজইলুশনমেন্ট’ একটি চমত্কার বই। তাছাড়া সেই স্টেশন সাক্ষাতের চর বছরের মধ্যেই জুলফি একজন পুরোদস্তুর কেবিনেট মন্ত্রী। ১৯৯৩-এর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ম্যারি অ্যান উইভার একটি দীর্ঘ রচনা লিখলেন ‘ভুট্টো’জ ফেইটফুল মোমেন্ট’। তিনি জানালেন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়। তার মৃত্যুর নিশ্চিত সংবাদটি যখন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে পৌঁছল, তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে অন্য জেনারেলদের বললেন ‘দ্য বাস্টার্ড ইজ ডেড।’ অথচ বেশ কয়েকজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ভুট্টো তার অতি অনুগত জিয়াউল হককে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। এ জিয়াউল হক পবিত্র মক্কা শরিফে গিয়ে ‘কসম’ করে বলেছিলেন, ভুট্টোকে ফাঁসিতে হত্যা করা হবে না। জিয়াউল হক ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন, কারাবন্দি করেছেন, বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে গণহত্যার অন্যতম প্রধান প্ররোচক হওয়ার অপরাধে ভুট্টোর বিরুদ্ধে শত ফাঁসির আদেশ হলেও বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকত না, কিন্তু যে উপলক্ষ সামনে এনে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল তা হাস্যকর। বিচার বিভাগের হাত দিয়ে হলেও এটি একটি নির্বাহী আদেশের হত্যাকাণ্ড, এটা সচেতনজনের বুঝতে বাকি ছিল না। নিজের সম্ভাব্য মৃত্যু নিয়ে ভুট্টো নিজেই বলেছেন, ‘তারা আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনি কিংবা অন্য কেউ কী সাক্ষ্য নিয়ে হাজির হচ্ছেন তা মোটেও বিবেচনা করার বিষয় নয়। তারা আমাকে এমন একটি হত্যাকাণ্ডের জন্য হত্যা করতে যাচ্ছে, যে অপরাধ আমি করিনি।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীই ১৯৭১-এ সামরিক-বেসামরিক-ভূমি অভিজাততন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করতে ভুট্টোকে ব্যবহার করেছে, ভুট্টোকে তার স্বপ্নপূরণ করাতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। আবার দেশটির সেনাবাহিনীই তাকে ছুড়ে ফেলেছে। কেবল ছুড়ে ফেলেনি, বিভিন্ন আঁতাত সৃষ্টি করে তিনি আবার যেন ফিরে আসতে না পারেন, সেজন্য তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। ভুট্টো নিজের অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলে মৃত্যুর আগে লিখে যেতে পেরেছেন—ইতিহাস আমাকে যত না ধ্বংস করবে তার চেয়ে বেশি ধ্বংস করবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ভুট্টোর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার চড়াই-উতরাই জীবনের আমৃত্যু সঙ্গী নুসরাত ভুট্টো ১৯৯৫ সালে হামিদ মীরকে বলেছেন, ‘আমি জানি আমার স্বামীর ফাঁসি হয়নি, তারা জেলখানায় তাকে হত্যা করেছে আর আমার ভয় হয় তারা (আমাদের সন্তান) মুর্তাজা ও বেনজিরকেও হত্যা করবে, কারণ তারা ভুট্টো পরিবারকে শেষ করে দিতে চায়।’ তার আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি। আলী মুর্তজা ভুট্টো ও বেনজির ভুট্টো দুজনই আততায়ীর হাতে নিহত হন। লারকানার নবাবনন্দন সিন্ধুর লারকানার রাজপুত পরিবারে স্যার শাহ নওয়াজ ভুট্টো এবং খুরশিদ বেগমের তিন পুত্রের সবচেয়ে ছোট জুলফিকার আলী ভুট্টো; প্রথম সন্তান সিকান্দার আলী সাত বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন, দ্বিতীয় পুত্র এমদাদ আলী ১৯৫৩ সালে ৩৯ বছর বয়সে সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। শাহ নওয়াজ ভুট্টো জুনাগড়ের দেওয়ান হিসেবে যথেষ্ট বিত্তশালী ছিলেন, ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখেছিলেন, ফলে নাইটহুডও পেয়ে যান। পুত্রের শিক্ষা ও শখ মেটাতে স্যার শাহ নওয়াজ টাকা খরচে কার্পণ্য করেননি। জুলফি ভর্তি হন বোম্বের ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কোনেন স্কুলে; পাকিস্তান কায়েম করার আন্দোলনে যোগ দেন। ১৬ বছর বয়সে পারিবারিক পছন্দে শিরিন আমির বেগমকে বিয়ে করেন, তবে এ সংসারটি তার শেষ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। ১৯৪৭-এ চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়া অবস্থায় চলে আসেন বার্কলিতে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায়; ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হন এবং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের সমন্বয় করার সম্ভাবনা নিয়ে কিছুদিন বক্তৃতা করে বেড়ান। ১৯৫০ সালে অক্সফোর্ড ক্রাইস্টচার্চ কলেজ থেকে আইন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৫৩ সালে লিঙ্কন’স ইন থেকে ব্যারিস্টার হন। ১৯৫১ সালে ইরানীয়-কুর্দি বংশোদ্ভূত নুসরাত ইস্পাহানিকে বিয়ে করেন। ভুট্টোর বোন মুনাওয়ারের বান্ধবী ছিলেন নুসরাত। ১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম জুলফিকারকে দেখেন। নয় বছর পর আবার দেখা জুলফি ও নুসরাতের—মুনাওয়ারের বিয়েতে। নুসরাত তখন ন্যাশনাল গার্ডের ক্যাপ্টেন। সেনাপোশাকের নুসরাত তাকে মুগ্ধ করেন। ১৯৫১ সালে জুলফি যখন তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন এক স্ত্রী থাকার করণে নুসরাত তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তার পরও বিয়ে হয়ে যায়, আমির বেগম বিয়েতে সম্মতি দেন এবং আমির বেগমের বাবা নবদম্পতিকে ডিনারে অ্যাপ্যায়িত করেন। ভুট্টো তার স্ত্রীকে ডাকতেন নুসরাতাম—আমার নুসরাত। গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার স্ত্রী নাহিদ মির্জা ছিলেন নুসরাতের বন্ধবী। তার মাধ্যমেই তিনি ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে পরিচিত হন এবং মেধাবী ভুট্টো তাকে জয় করতে সময় নেননি। ১৯৫৮ সালে তিনি যখন তাক

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD