April 27, 2024, 5:32 am

চায়না দুয়ারির ফাঁদে হুমকির মুখে দেশীয় মাছ

বাঙালির অন্যতম একটি পরিচয় হচ্ছে মাছে ভাতে বাঙালি। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় প্রায় সব জায়গার নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, জলাশয় গুলো বিভিন্ন ধরনের মাছ দিয়ে ভরা থাকে। জেলেরা নানা রকমের ফাঁদ ব্যবহার করে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। স্থানীয় এসব ফাঁদ টেপরাই, চেচলা, পোলো, ঝাঁকি জাল, চটকা, কোচা, জালি ইত্যাদি নামে পরিচিত।

এছাড়াও তারা বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের জাল কিনে মাছ শিকার করে। বর্ষাকালে এদেশের নদী-নালা, খাল-বিল গুলোর কানায় কানায় পানি দিয়ে ভরে যায়। এ সময়ে নতুন পানি পেয়ে মাছ গুলো তাদের বংশবিস্তার করে। ফলে নদী-নালা, খাল-বিল গুলোতে প্রচুর পরিমাণে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ ছড়িয়ে পড়ে। জেলেরা এ সময় মাছ ধরে ব্যস্ত সময় পার করে। জেলেদের পাশাপাশি অপেশাদার সৌখিন মানুষও নেমে পড়ে মাছ ধরার নেশায়।

সময়ের ব্যবধানে এখন বাজারে এসেছে বিশেষ এক ধরনের চায়না দুয়ারি জাল। উক্ত জালটি অঞ্চলভেদে রিং জাল, চায়না দুয়ারী, ম্যাজিক জাল ইত্যাদি নামে পরিচিত। অদূর ভবিষ্যতে জালটির ব্যবহার দেশীয় মাছ বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হয়। কেননা  ৫০ থেকে ১০০ ফুট লম্বা জালটিতে অসংখ্য প্রবেশ মুখ রয়েছে।

ফলে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ যেমন পুটিঁ, কৈ, খলসে, টাকি, চিংড়ি, ট্যাংরা, শিং, মাগুর, চেলা, দারকিনা, গজার, মলা, ঢেলা, বৈরালী, কাজলী, পাবদা, শোল ইত্যাদি মাছ প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে। রিং জালের ফাঁস অনেক ছোট হওয়ায় ছোট মাছগুলোও রেহাই পাচ্ছে না এই ফাঁদ থেকে। ছোট বড় মাছের পাশাপাশি এ জালের ফাঁদে পড়ে নিধন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জলজ প্রাণী। এছাড়াও প্রজনন মৌসুমে ধরা হচ্ছে ডিমওয়ালা মাছ। এর ফলে মাছের বংশবিস্তার মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এবং প্রাপ্তিতে সহজলভ্যতা থাকায় চায়না রিং জালটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ধুমছে ক্রয়-বিক্রয় চলছে। সনাতনী পদ্ধতিতে মাছ ধরার চেয়ে এই রিং জালের সাহায্যে অল্প পরিশ্রমে অধিক পরিমাণে মাছ আহরণ করা যায়। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পূর্বের কৌশল বাদ দিয়ে জেলেরা রিং জাল ব্যবহারের দিকেই বেশী ঝুকছে।

ব্যবহারবিধি সহজ হওয়ায় জেলেদের পাশাপাশি মৌসুমী মাছ শিকারী এবং সাধারণ মানুষ এ জালের ব্যবহার শুরু করেছে। ছোট-বড় সব ধরনের মাছ ধরা পড়ছে মৎস শিকারীদের এই জালে। ফলশ্রুতিতে ক্রমেই মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে নদী-নালা,খাল-বিল গুলো। হারিয়ে যেতে বসেছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ।

আমরা জানি, মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় একটি পুষ্টি উপাদান হচ্ছে আমিষ। দেশের মানুষের আমিষের বিশাল একটি চাহিদা পূরণ করে এই দেশীয় মাছ। এদেশের মানুষের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটায় এই দেশীয় মাছ। দাম কিছুটা হাতের নাগালে থাকায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আমিষের চাহিদা পূরণে মাছই একমাত্র উপাদান।

তাই সরকারের উচিত এসব মাছের অস্তিত্ব সংকট মোকাবেলায় অতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায় চরম হুমকির মুখে দেশীয় মাছ। যদিও প্রশাসন ইতিমধ্যে এই জালের ব্যবহার রোধে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেছে। বেশ কিছু অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে।

কিন্তু মাঝে এই তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আবার এই জাল ব্যবহারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই অসাধু মহল। প্রশাসনের উচিত এই জাল ব্যবহাররোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাল তৈরীর কারখানাগুলোতে যাতে এধরনের জাল প্রস্তুত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সেই সাথে অননুমোদিত কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে। অবৈধ জাল ক্রয়-বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা জারী করতে হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এছাড়াও মৎস্য আইন বাস্তবায়নে নির্দেশনা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাজ করতে হবে।

প্রশাসনের অভিযানের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। রিং জালের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। ভবিষ্যতে যে সংকটাপন্ন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তা সম্পর্কে অবগত করতে হবে।

সবাই যাতে এই জাল ব্যবহার থেকে বিরত থাকে সেই ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। একটা সময়ে এদেশের নদী-নালা,খাল-বিল,হাওড়-বাওড় ইত্যাদি দেশীয় মাছের প্রাচুর্যতা ছিল। ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে এসব থেকে বঞ্চিত না হয় এজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বাঙালির অন্যতম পরিচয় ছিল মাছে ভাতে বাঙালি। বাঙালির এই স্বকীয়তা যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে সবার সুদৃষ্টি কাম্য।

লেখক : এস আর শাহিন শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ

srshahinkurigram@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD