April 27, 2024, 10:19 am

রবিউল আউয়াল মাসের ফজিলত ও আধ্যাত্মিক দর্শন

মানবজাতির জন্য দিন এবং রাত হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।দিনরাত অতিবাহিত হয় সময়ের মাধ্যমে যা প্রতিটি প্রাণীর জন্য সাফল্যের সিঁড়ি এই সময়ের সঠিক ব্যবহার যেমন জীবনে উন্নতি দিতে পারে তেমনি ভাবে দুনিয়ার সময়কে পূর্ণের মাধ্যমে অতিবাহিত হলে আখেরাতের জীবন হবে সৌখিন। দিন রাত মহান আল্লাহ র  কুদরতের নিদর্শন। দিন-রাতের অব্যাহত গতিময়তা আল্লাহ পক্ষ থেকে বান্দার জন্য বিরাট অনুগ্রহ। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি এমন সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে একে অন্যের পশ্চাতে আগমনকারী বানিয়েছেন সেই ব্যক্তির জন্য, যে বুঝতে চায় অথবা শোকর আদায় করার ইচ্ছা করে।’ (সূরা ফুরকান,)

রবিউল আউয়াল অর্থ প্রথম বসন্ত। বসন্তের আগমনে যেমন গাছের পুরনো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতার মাধ্যমে গাছ নতুন করে সজীবতা লাভ করে, অনুরূপ বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা:-এর আগমনে অতীতের পয়গম্বরদের শরিয়ত রহিত হয়ে মুহাম্মদ সা:-এর ইসলাম নামক শরিয়ত সঞ্জীবিত ও পূর্ণতা লাভ করে। আরবি মাসগুলোর মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসবিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ মাসটি মানব ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের স্মারক। এ মাসেই সাইয়্যেদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন হজরত মুহাম্মদ সা: এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, আবার এ মাসেই তিনি তাঁর ওপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব পালন শেষে নিজ প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে গমন করেন। এ মাসে মদিনায় হিজরত করেন। সুতরাং এক দিকে এ মাসে রাসূল সা:-এর শুভাগমন বিশ্ববাসীকে পুলকিত করে, অন্য দিকে এ মাসে তাঁর প্রস্থান মুসলিম বিশ্বকে শোকাভিভূত করে। তাই এ মাসটি একই সাথে শোক ও আনন্দের। সে কারণেই এ মাসের আলাদা একটি মাহাত্ম্য , শ্রেষ্ঠত্ব ও আধ্যাত্মিক দর্শন রয়েছে অন্যান্য মাসের ওপর। বিশেষ করে রাসূল প্রেমিকদের জন্য উম্মাতে মোহাম্মাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের মাস।

এ মাসের ফজিলত অপরিসীম। কোনো কোনো হাদিসে রবিউল আউয়ালের প্রথম দিন রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি এ মাসের প্রথম তারিখে রোজা রাখবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ণ বছর রোজা রাখার সওয়াব দান করবেন।’ তা ছাড়া, এ মাসে রাসূলের ওপর দরুদ পড়ার গুরুত্বও অনেক। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আমি তার ওপর ১০০ বার দরুদ পাঠ করব।’ এ ছাড়াও এ মাসে প্রতিদিন গোসল করা, অধিক পরিমাণে নফল নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা ও অন্যান্য নফল ইবাদত করার ফজিলতও বর্ণিত হয়েছে। তবে হাদিসগুলোর সনদের মান কিছু টা দুর্বল। তবে নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে বাধা নেই।

সামাজিক ও ঐতিহ্যগত কারণেও উম্মাহর বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম এই মাসের গুরুত্ব বিবেচনায় রমজানুল মোবারকের ওপরও এ মাসকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। কেননা রমজানুল মোবারকে কুরআন নাজিল হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠ হলেও যার ওপর কুরআন নাজিল হয়েছে, সেই মহান ব্যক্তির আগমন হয় এ মাসে। সে কারণে এ মাসের ফজিলত অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি। কারণ সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে আল্লাহর কাছে মানুষের মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশি ।আর সমস্ত মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলার কাছে সবচাইতে প্রিয় সবচাইতে দামি হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই কারণে আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে )রহমত রূপে প্রেরণ করেছেন।
মাহে রবিউল আউয়াল জগৎবাসীর কাছে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহর কাছে নববী আদর্শের তথা আত্মশুদ্ধি ও সমাজ সংস্কারের পয়গাম নিয়ে আসেন। এ পয়গাম বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা ভূখণ্ডের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সার্বজনীন।

নবীজী সা:-এর আগমন ঘটেছিল এমন এক সময়ে, যখন পুরো আরব জাতি হত্যা, রাহাজানি, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা- সব কিছু মিলিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগে বসবাস করছিল। ঠিক সে সময়ে বিশ্ববাসীর মুক্তির দূত হিসেবে আগমন করেন দোজাহানের সরদার মুহাম্মদ সা:। মারামারি, হানাহানির এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূলে করিম সা:কে পাঠিয়েছেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। সেই রহমতের বারিধারায় সমস্ত অসহায় নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষেরা পেয়েছিল আলোর দিশা ।রাসূলুল্লাহ সা: ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন এবং ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মাত্র ২৩ বছরে সমাজে মনুষ্যত্ব নির্মাণের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।

দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার এই রবিউল আউয়াল মাসেই প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান তিনি। রবিউল আউয়ালের কোনো একদিন রাসূল সা:-এর শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায়। সাথে সাথে কষ্টও বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সামান্য স্বস্তিবোধ হলে তিনি মাথায় পট্টি বেঁধে মিম্বারে আরোহণ করেন। সমবেত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্য রাসূল সা: বলেন, ‘আমি যদি কাউকে আঘাত করে থাকি তাহলে সে আমার পিঠে চাবুক মেরে প্রতিশোধ গ্রহণ করুক।’ এই বলে তিনি নিজের পিঠ উন্মোচন করে দিলেন। (বুখারি, মুসলিম)। কারণ হচ্ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদিক দিয়ে সর্বক্ষেত্রে ছিলেন ঋণমুক্ত। তাই আমাদের উচিত দেনা পাওনা মুক্ত জীবন যাপনে সচেষ্ট হওয়।

এ মাসের অন্যতম তাৎপর্য হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সা:কে ভালোবাসা। কারণ আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে মহানবীকে ভালবাসতে হবে যা কোরআন দ্বারা প্রমাণিত।রাসূলের ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পযন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে আমাকে তার বাবা-মা, ছেলে-সন্তান ও সব মানুষ থেকে অধিক ভালো না বাসবে।’ (বোখারীও মুসলিম)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তার জন্ম তারিখ সোমবার এ কারণে তিনি প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন। অর্থাৎ ইবাদতের মাধ্যমে দিবস পালনে কোন বাধা নেই। ইসলাম কোন দিবসে কোন ঈদে বা কোন সময়ে কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো কাজ সমর্থন করে না। এই মাসে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত রসুলের মহব্বতে বেশি বেশি দরুদ ও সালাম জিকির তসবি তাহলীল মিলাদ দোয়া দান খয়র া আত্মীয়-স্বজনকে খাওয়ানো সর্বোপরি কোরআন সুন্নাহ ভিত্তিক জীবন পরিচালনা করা অতীব জরুরী। মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত রাসূল প্রেমিক হিসেবে গড়ে ওঠার তৌফিক দান করুন

লেখক: মোহাম্মদ মোস্তাকিম হোসাইন| ইসলামি কথা সাহিত্যিক, গবেষক ও কলামিস্ট। মোবাইল ০১৭১২৭৭৭০৫৮ email mostakim bogra@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD