October 3, 2023, 2:11 pm
ষ্টাফ রিপোর্টারঃ বগুড়া পৌরসভায় প্রায় ১০ লাখ মানুষের বসতি,আয়তনে দেশের বৃহত্তম । এই পরিমাণ জনবসতি থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫০ টন ময়লা-আবর্জনা জমা হচ্ছে। যেগুলো নিয়ে ফেলা হচ্ছে শহরের ধারেই ভাগারে। অথচ প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন পৌরসভা হয়েও আজো আধুনিক কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু হয়নি। ফলে মানুষের ফেলা দেয়া বর্জ্যগুলো ঘুরে ফিরে পড়ে থাকছে লোকালয়ের মাঝেই।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এভাবে উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখায় বর্জ্য-আবর্জনা থেকে দূষিত হচ্ছে পানি, বায়ু। ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে প্রাণবৈচিত্রে।
আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু না করার ব্যর্থতা স্বীকার করছে বগুড়া পৌরসভা। তাদের দাবি, বড় আকারের বাজেটের প্রকল্প ছাড়া এমন পরিকল্পনা নেয়া বগুড়া পৌরসভার পক্ষে সম্ভব নয়। বিগত সময়ে একবার এমন প্রকল্প প্রস্তাবনা এসেছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
বগুড়া পৌরসভা সূত্র জানায়, ১৮৭৬ সালে বগুড়া পৌরসভা স্থাপিত হয়। ২০০৬ সালের আগে পর্যন্ত এখানে ছিল ১২ টি ওয়ার্ড। ২০০৭ সালে ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে ২১ টি ওয়ার্ডে বর্ধিত করা হয় এই পৌরসভাকে। ২০০৭ সালের আগে শহরের প্রতি মহল্লায় ডাস্টবিন থাকতো। পৌর বাসিন্দারা তাদের বাসা-বাড়ির আবর্জনা সেখানে ফেলতেন। পরবর্তীতে পরিবেশ রক্ষায় সব ডাস্টবিন সরিয়ে দেয়া হয়। ভ্যানের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ ডাস্টবিন চালু করে পৌরসভা। এই কাজের জন্য গঠন করা হয় মহল্লাভিত্তিক কমিউনিটি বেইজ অর্গানাইজেশন (সিবিও)। এই সংগঠনের মাধ্যমে ভ্যানগাড়িতে করে ময়লা নিয়ে শহরের বিভিন্ন ট্রান্সফার স্টেশনে রাখা হয়। সেখান থেকে গার্বেজ ট্রাকে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লা নিয়ে গিয়ে ফেলে ভাগাড়ে।
টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বগুড়া শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ও মিউনিসিপ্যাল সাপোর্ট ইউনিটের আওতায় এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এতে বর্জ্য থেকে সার তৈরি, বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও রাখা হয়। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেনি বগুড়া পৌরসভা।
এই সিবিওদের দেখভাল করে পৌরসভার কনজারভেন্সি শাখা। এই শাখার সূত্র বলছে, বগুড়া পৌরসভায় প্রায় ১৭২ টি সিবিও আছে। এ ছাড়া গার্বেজ ট্রাক আছে ১৯টি। এর মধ্যে মধ্যে দুটি পৌরসভার নিজস্ব ট্রাক, বাকিগুলো ভাড়া নেয়া।
এ ছাড়া শহরের আবজর্না রাখার ট্রান্সফার স্টেশনের মধ্যে স্থায়ী ৯টি ও অস্থায়ী ৭টি। ভাগাড় বা ডাম্পিং স্টেশন দুটি। এ দুটির একটি বগুড়া শহরের জয়পুর পাড়ায় এবং অপরটি শহরের বাইরে এরুলিয়াতে। তবে দুটি ডাম্পিং স্টেশনই বন্ধ আছে।
কনজারভেন্সি শাখার সুপারভাইজার মামুনুর রশিদ বলেন, শহরে ১৯ টি ট্রাক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে একশ বার ময়লা আবর্জনা অপসারণ করা হয়। এতে অন্তত ২৫০ টন আবর্জনা হবে। সেগুলো ফেলা হয় বাঘোপাড়ায় মহাসড়কের ধারে ব্যক্তিমালিকাধীন জায়গায়। আমাদের দুটি ভাগাড় বর্তমানে বন্ধ আছে। আবার এখন যেখানে ফেলা হচ্ছে, সেই জায়গার মালিক নিষেধ করলেই নতুন জায়গা খুঁজতে হবে।
আবর্জনার পরিস্থিতি দেখতে শহরের একাধিক ট্রান্সফার স্টেশন ঘুরে দেখা হয়। এগুলো হলো বনানী রেশম উন্নয়ন বোর্ড, ঠনঠনিয়া, সেউজগাড়ী কৃষি অফিস, রেলস্টেশন, শিববাটি শিল্পকলা একাডেমির সামনে।
এগুলো ছাড়াও শহরের প্রাণকেন্দ্র এলাকার সপ্তপদী মার্কেটের সামনে, ফতেহ আলী বাজারের সামনে প্রতিদিনই ময়লার স্তুপ জমা হয়। এর মধ্যে অনেক এলাকার আবর্জনা সরাসরি শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীতে পড়ছে। এসব থেকে ময়লা অপসারণ করলেও দূর্গন্ধ সব সময় ভোগায় স্থানীয়দের।
গত রোববার ঘুরে দেখা যায়, ট্রান্সফার স্টেশনগুলোর কয়েকটিতে শেড থাকলে মোটাদাগে সেগুলো উন্মুক্ত। মোবাইল ডাস্টবিনে করে সিবিও শ্রমিকরা আবর্জনা নিয়ে এসে স্টেশনের সামনে ফেলছেন। এগুলো বেশিরভাগ রাস্তার ওপরে পড়ে। আবার কাক, কুকুর ও কিছু ছিন্নমূল মানুষ এসব আবর্জনা ঘাটাঘাটি করে রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়। ফলে পুরো ট্রান্সফার স্টেশন এলাকা জুড়ে দুর্গন্ধ ভেসে বেড়ায়। এতে আশেপাশের বাসিন্দারা ছাড়াও পথচারীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।
শিববাটি এলাকার ট্রান্সফার স্টেশনের পাশের মুদি দোকানদার মেহেদী হাসান জানান, এখন যেখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে, আমার দোকান সেখানেই ছিল। আবর্জনার কারণে দোকান সরানো হয়েছে। তবুও দুর্গন্ধ লাগে। ময়লাগুলো ডাস্টবিনের ঘেরার মধ্যে থাকলেও হয়। এগুলো সব সময় রাস্তার অর্ধেক জুড়েই পড়ে থাকে।
সেউজগাড়ী এলাকার বাসিন্দা সামসুজ্জোহা পাভেল বলেন, ময়লা নিয়ে গিয়ে কী করে? সেগুলো তো আবার শহরের আরেক ধারে ফেলে রাখে। এতে কী লাভ? ময়লা আবর্জনা তো শহরের কোথাও না কোথাও মধ্যেই স্তুপ আকারে পড়ে থাকছে। এর যে দূষণ প্রভাব তা তো আমাদের ঘিরে রাখছে। এর চেয়ে বর্জ্য রিসাইকেলিং করার ব্যবস্থা চালু করলে সেটি সবার জন্য ভালো হয়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন বগুড়ার বাসিন্দা ও অনুসন্ধানী ক্রিডস নামে বেসরকারি সংস্থার পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আতিকুর রহমান মল্লিক। তিনি বলেন, সাধারণত বর্জ্য বাসা-বাড়ি, শিল্প, চিকিৎসাখাত বিভিন্ন উৎস থেকে আসে। এগুলোতে দস্তা, সালফার, ক্যাডমিয়াম, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে। এগুলোর অনুপাত আবার নির্ভর করে বর্জ্যের ধরনের ওপর।
বগুড়ায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু না হওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বাপার বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান। তিনি জানান, এটা আমাদের জন্য আফসোস যে আজো আমরা বর্জ্য রিসাইকেলিং ব্যবস্থাপনা চালু করতে পারিনি। খোলা স্থানে আবর্জনা থাকায় সেটি নদীর পানিতে, মাটিতে মিশছে। বাতাস দূষিত করছে। ২০১৯-২০ সালের দিকে নেদারল্যান্ড থেকে প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা এসেছিল বর্জ্য রিসাইকেল করার। এটি নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রনালয়ের কাগজপত্রের জটিলতায় সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। পরে প্রকল্পটি ফিরে যায়।
এ বিষয়টি স্বীকার করেন বগুড়া পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা শাজাহান আলম। তিনি জানান, আমাদের অন্যতম সমস্যা লোকবল। এ জন্য আমাদের কাজে একটু ঘাটতি থাকে। আর আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরনের প্রকল্প প্রয়োজন। এসব ডিপিএইচই, ইউএন এর মতো সংস্থাগুলো দিতে পারে।
তবে পৌর নির্বাহী কর্মকতা দাবি করেন, আগামিতে ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প আসছে বগুড়া পৌরসভায়। এতে রাস্তা, ড্রেন এসব নতুন করে নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্প পেলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটু গতি আসবে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, বগুড়ায় বর্জ্য রিসাইকেল করার বিষয়ে পৌরসভার সঙ্গে কথা হয়েছে। বিগত আমরাও বলেছি শহরের মধ্যে আবর্জনা না রেখে যেখানে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না এমন স্থানে রাখতে। আর সেটি একটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা মনে করতে হবে। তবে সংকট হলো আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপনের মতো বড় পরিসরের জায়গা পৌরসভার নেই। পৌরসভা যদি সেরকম জায়গা বের করে আর কোনো প্রকল্পের ডিজাইন করে সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই দেখবো।