April 27, 2024, 5:43 am

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঘানি শিল্প

ঘানির সরিষার তেল এক সময়  বাঙালির রান্নাঘরের অন্যতম অনুসঙ্গ ছিল। বিবাহ, ঈদ, আকিকা, পূজা-পার্বণ, পারিবারিক অনুষ্ঠানে এ তেল ছিল অপরিহার্য। তবে কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির উৎকর্ষে হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী ঘানি শিল্প। এখন আর ঘানি খুব একটা চোখে পড়ে না। গরু দিয়ে কাঠের ঘানি ঘুরিয়ে সরিষার তেল বের করার দৃশ্যও বিরল। কয়েকজন তেলীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাছের ভালো কাঠ দিয়ে ঘানি তৈরি হয়ে থাকে। ঘানির চারপাশে একসময় গরু বা অন্য কোনো প্রাণি জোঁয়াল কাঁধে নিয়ে ঘুরতো। জোঁয়ালের গোড়ার দিকে বেশ কিছু ভারী পাথর ও ইট থাকে। যেন ঘানির ভিতরে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এ জোঁয়াল যত ঘুরবে তত বেশি চাপ সৃষ্টির ফলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হতো। সেই চাপে বের হতো সরিষার তেল। এ তেল ফোঁটা ফোঁটা করে পরে একটি পাত্রে জমা হতো। আশপাশের মানুষ চোখ বন্ধ করে বুঝে নিতো সরিষা মাড়াই করে কলু বা তেলী সম্প্রদায় উৎপাদন করছে খাঁটি সরিষার তেল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দের সঙ্গে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো সরিষার তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ। বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহারে হারিয়ে যেতে বসেছে আদিকালের ঘানি শিল্পের সেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। এখন খাঁটি সরিষার তেল সবাই খুঁজলেও ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের খবর কেউ রাখে না। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর সেই ঘানি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের নিকট ঘানি জিনিসটি অপরিচিত। অথচ দুই দশক পূর্বেও গ্রামবাংলায় ঘানি দেখা যেত। প্রক্রিয়াজাতকরণের এ পুরোনো পদ্ধতি থেকে পাওয়া তেল মান ও বিশুদ্ধতার দিক থেকে সেরা ছিল। পেশাটি হারিয়ে যাওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে-আধুনিক প্রযুক্তি। কেউ কেউ এখনো এ ঘানি শিল্পকে ধরে রেখেছেন। কাঠের তৈরি এ ঘানিকে দেশের কোনো কোনো এলাকায় গাছের তেল বা তেলেরগাছ নামেও পরিচিত। এ পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কলু বা তেলী নামে পরিচিত। তবে ঘানিতে তেল ভাঙানোর প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ হওয়ায় আধুনিক মেশিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হিমশিম খেতে খেতে এখন বিলুপ্তির পথে। বাধ্য হয়ে অনেকেই পরিবর্তন করছেন এ পেশা। তবে এখনো ভালোবেসে পূর্বপুরুষের এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন কেউ কেউ। দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে এখন কাঠের ঘানির পরিবর্তে প্রযুক্তির আশীর্বাদে লোহার ঘানিতে ভাঙা হচ্ছে সরিষার সঙ্গে বিভিন্ন দ্রব্যাদি। ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে লোহার এ ঘানিগুলোতে কেবল সরিষা-ই নয় তিল, তিশিও ভাঙানো হচ্ছে। এতে কাঠের ঘানির চেয়ে উৎপাদন খরচও অনেক কম। তাই এ অসম প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না কাঠের ঘানিতে উৎপাদিত খাঁটি সরিষার তেল।

আগেকার দিনে দিনরাত গরু দিয়ে কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোঁটায় ফোঁটায় নিঙড়ানো খাঁটি সরিষার তেল গ্রাম-গঞ্জে মাটির হাড়িতে ফেরি করে এবং হাটবাজারে বিক্রি হতো। হাঁড়ির ঢাকনির নিচে থাকতো তালের বিচির খোসা দিয়ে তৈরা করা বাঁশের হাতলের ওড়ং। তেল তুলে দেয়ার জন্য এ ওড়ং ব্যবহার করা হতো।এভাবেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন ঘানি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। বাজারে চাহিদা থাকলেও খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আর বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না তারা। আবার কোনো কোনো লোহার ঘানিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সরিষার সঙ্গে চালের গুঁড়া, পিঁয়াজ, শুকনা মরিচসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত করে ভেজাল সরিষার তেল উৎপাদন করছেন। এভাবে কৃত্রিম তেল দখল করেছে সরিষার তেলের বাজার। কৃত্রিম তেল স্বল্প দামে বিক্রি করায় ঘানিতে দিনরাত পরিশ্রম করে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদন করে স্বল্প দামে বিক্রি করতে পারছেন না উৎপাদনকারীরা। ফলে তারা  প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না।

চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর গ্রামের বড়ভিটা, হাসিমপুর, আব্দুলপুর, জোত রামধনপুরসহ বিচ্ছিন্নভাবে এখনো ঘানিতে তেল উৎপাদন করছেন অনেকে। আবার অনেকে যুগের পরিবর্তনে আর পর্তা (সুবিধা) করতে না পারায় এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

উপজেলার নশরতপুর গ্রামের বড়ভিটা তেলীপাড়ার মোকছেদ আলী জানান, এখন হাতেগোনা ঘানির সংখ্যা। ঘানিভাঙা তেলের চাহিদার পরেও আধুনিক মেশিন নির্ভর শিল্প ও প্রযুক্তি প্রসারের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘানি শিল্প। ঘানিতে ৫ কেজি সরিষা ভাঙতে অনন্ত ২ ঘন্টা সময় লাগে। এভাবে দিনে একটি ঘানি থেকে ৩০-৩৫ কেজি সরিষা ভাঙা সম্ভব হয়। বর্তমানে প্রতিকেজি তেল খুচরা বিক্রি হয় ৪০০ টাকা দরে। তবে কেমিক্যালসহ নানাভাবে উৎপাদিত

সরিষার তেল বাজারে স্বল্প দামে বিক্রি করায় ঘানির খাঁটি সরিষার তেল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বেশি দামের কারণে অনেকে কেনেন না। তিনি আরো জানান, একটি ঘানিতে গড়ে এক-দুইটি গরু প্রয়োজন হয়। গরুর লালন-পালন, খাদ্য জোগাড় করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, খাবার জোগাড় করাসহ দেখভাল করতে শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। এ কারণে অনেকে ইচ্ছে থাকলেও আর ঘানি চালাতে চান না। আমার বাপ-দাদার আমল থেকে এ ব্যবসা চলে আসছে। গ্রামে একসময় সবাই এ পেশায় ছিল। এখন আর নেই। আমার ভবিষ্যত প্রজন্ম বা বংশধর এ পেশায় আর আসবে না।

উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের বিন্যাকুড়ি হাটে তেলী আজিজার রহমান জানান, তার বাড়িতে তিনটি ঘানি বা তেলেরগাছ রয়েছে। তার বাপ-দাদাও ছিলেন তেলী। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে এ পেশায় নেমেছেন। সারাবছর চলে তার এ তিনটি ঘানি। বিন্যাকুড়ি হাটে সপ্তাহের শুক্রবার ও মঙ্গলবার তেল বিক্রি হয়। এছাড়াও নিত্যদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ তেল কিনতে তার বাড়িতে আসেন। শীতকালে ছোট-বড় সকলেই সরিষার তেল গায়ে (শরীরে) মাখেন। তাই শীতকালে সরিষার তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং বিক্রিও বেশি হয়। কাঠের ঘানির তেলের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় এর ক্রেতা কম। তারপরেও অনেক ক্রেতা মূলত বিশুদ্ধতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

আরেক তেলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, তার বাপ-দাদাও তেলী ছিলেন। ৫ বছর পূর্বে তার পিতা আব্দুস সামাদ মৃত্যুবরণ করলে তিনি পিতার এ পেশার হাল ধরেন। তিনি আরো জানান, প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা, সরিষা ও গো-খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তেলীরা। তবে এখনও অনেক ক্রেতা লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে কাঠের ঘানিতে তৈরি শতভাগ বিশুদ্ধ সরিষার তেল খুঁজে থাকেন। সে জন্য দুই-একজন তেলী তাদের পূর্বপুরুষদের পেশা ধরে রেখেছেন। ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের ক্রেতাদের একটি বড় অংশ হচ্ছে প্রবাসীরা। তারা বাড়িতে এলে এ তেল কিনে নিয়ে যান কিংবা স্বজনদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে নেন। এ তেল প্রতিকেজি ২৬০-২৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বৈদ্যুতিক মোটরচালিত লোহার ঘানির কারখানা এ শিল্পকে বিপন্ন করেছে। গ্রামবাংলার হাটবাজারে ঘানিতে উৎপাদিত খাঁটি সরিষার তেলের চাহিদা থাকলেও কৃত্রিম সরিষার তেল বাজার দখল করায় ঘানি শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। সেই সঙ্গে দাম ও অপ্রতুলতার কারণে ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD