July 27, 2024, 5:04 am

নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ

যমুনা নিউজ বিডি:  বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, আমাদের গৌরবের প্রতিষ্ঠান ও দৈনিক ইত্তেফাক পাবলিকেশন্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫৫তম প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯৬৯ সালের ১ জুন ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক। সাংবাদিকতার জগতে মানিক মিয়া এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। তিনি মানুষের মুক্তির পক্ষেই নিজেকে, সাংবাদিকতাকে নিয়োজিত করেছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে আজীবন তিনি এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে থেকেছেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সেজন্য তিনি বাংলার মানুষের কাছে ‘নির্ভীক সাংবাদিক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানে যে ভূমিকা পালন করেছিল, তা ছিল সময়ের দাবি। আওয়ামী লীগের সেই সময়ের রাজনীতিকে ইত্তেফাক জনগণের দাবি বলেই মনে করেছিল। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অবস্থান, ইত্তেফাকের সাংবাদিকতা এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সত্ ও নির্মোহ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তাকে মানুষের অধিকারের কথা বলতে হয়েছে।

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়ায়। তার বাবা মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। গ্রামের পূর্ব ভাণ্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষাজীবনের শুরু। পিরোজপুর জেলা সরকারি হাই স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৩৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার অন্তর্গত গোয়ালদি গ্রামের অভিজাত পরিবারের খোন্দকার আবুল হাসানের কন্যা মাজেদা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের পরিচালনা বোর্ডের সেক্রেটারি পদে যোগ দেন।

১৯৪৮ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকায় চলে আসেন এবং সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ রূপান্তরিত হয়। মানিক মিয়ার সম্পাদনায় দৈনিক ইত্তেফাক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী বন্ধ হয়ে যায়। গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি ফের প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে সৃষ্ট দাঙ্গা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিরোধে স্থাপিত দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির প্রথম সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ১৯৬৯ সালের ২৬ মে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কাজে রাওয়ালপিন্ডি যান। সেখানেই ১৯৬৯ সালের ১ জুন রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কর্মসূচি :দিনটি উপলক্ষ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আজিমপুর মাজার প্রাঙ্গণে সকাল ৮টা থেকে কোরআনখানি এবং বেলা ১১টায় দোয়া ও তবারক বিতরণ করা হবে। মরহুমের কনিষ্ঠ পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসভবনে কোরআনখানি ও দোয়া মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মরহুমের জ্যেষ্ঠ কন্যা মরহুমা আখতারুন্নাহার বেবীর নিজ বাসভবনে বাদ মাগরিব কোরআনখানি ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।

অন্যদিকে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃতুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসা জ্ঞাপন করেছেন—জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম। এক বিবৃতিতে জেপির মহাসচিব বলেন; মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন আমাদের সংবাদিকতা জগতের একজন কিংবদন্তিতুল্য। এই মহান ব্যক্তি দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তার চরম লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রাজনীতির ময়দানে পাকিস্তানি শাসক-শোষক চক্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিলেন, তখন দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার এই সংগ্রামের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিলেন। এজন্য তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে কারানির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে, ইত্তেফাক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তবুও আপসহীন এই মহান সাংবাদিক মাথানত করেননি।

জাতীয় পার্টি-জেপির কর্মসূচি :আজ সকাল সাড়ে ৯টায় আজিমপুরস্থ কবরস্থানে তফাজ্জল হেসেন মানিক মিয়ার মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও মাজারে দোয়া মহফিলের আয়োজন করেছে। এতে দলীয় নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন।

ভাণ্ডারিয়া (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, ভাণ্ডারিয়ায় বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় ভাণ্ডারিয়ার কৃতীসন্তান তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে।

এ উপলক্ষ্যে সকাল ১০টায় ভাণ্ডারিয়া মজিদা বেগম মহিলা কলেজের শিক্ষক, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের আয়োজনে আলোচনাসভা শেষে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. এনায়েত করিম খোকন। এছাড়া পৃথকভাবে মজিদা বেগম বলিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেলা ১১টায় বিদ্যালয় মিলনায়তনে আলোচনাসভা শেষে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে একই দিন পৃথকভাবে উপজেলার পূর্ব-ভাণ্ডারিয়া মিয়া বাড়ি (মানিক মিয়ার নিজ বাড়ি) জামে মসজিদ কমপ্লেক্সে বাদ আসর আলোচনাসভা শেষে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে উপজেলার উত্তর-পূর্ব ভাণ্ডারিয়ায় বেসরকারি অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন ‘আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গ্যালারির’ উদ্যোগে গ্যালারি-সংলগ্ন মোল্লা ছোমের উদ্দিন জামে মসজিদে বাদ আসর মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD