July 27, 2024, 5:35 am
নাটোর প্রতিনিধি: রাতের কুয়াশা ভোরের শিশির বলছে, শীত সন্নিকটে। শীত বলতে গ্রামীণ জনপদের কতশত আয়োজন। সেই আয়োজনের প্রধান উৎস্য খেজুরগুড়। গাছিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খেজুর রস সংগ্রহের কাজে। এবার শীত মওসুমজুড়ে নাটোরে শতকোটি টাকার খেজুরগুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে কৃষি অফিস।
নাটোরের গুরুদাসপুর, লালপুর, সিংড়া, নলডাঙ্গা ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় খেজুরের রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করা হয়। এর মধ্যে লালপুর উপজেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা বেশি থাকায় গুড়ও বেশি উৎপাদন হয়ে থাকে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, জেলাজুড়ে মোট খেজুরগাছ রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৯০টি। রস দেওয়ার মতো উপযোগী গাছের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি। এর মধ্যে লালপুরে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি, বড়াইগ্রামে ১ লাখ ৬ হাজার, গুরুদাসপরে ৭৫ হাজার ৯৪০, নাটোর সদরে ৪৪ হাজার, নলডাঙ্গায় ৬ হাজার, সিংড়ায় ৬০ হাজার ও বাগাতিপাড়ায় ২১ হাজার ৩৫০টি খেজুর গাছ আছে।
জানা গেছে. শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৫ দিন খেজুর রস সংগ্রহের জন্য ধরা হয়। এই সময়ে জেলাজুড়ে অন্তত পক্ষে দশ থেকে ১৫ হাজার মানুষ খেজুরের রস সংগ্রহ, গাছের পরিচর্যা এবং গুড় তৈরিতে যুক্ত থাকেন।
কৃষি অফিস বলছে, রস সংগ্রহের উপযোগী প্রতিটি গাছের রস থেকে গুড় উৎপাদন হয় ১৭ দশমিক ৪০ কেজি। এই হিসেবে মওসুমে প্রায় ৯ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কেজির হিসেবে ৯৬ লাখ ২৩ হাজার ৮৬২ কেজি খেজুরের গুড়ের বাজার মূল্য প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। গত বছরও শতকোটি টাকার খেজুরের গুড় উৎপাদন হয়েছিল।
হিসেব মতে, প্রতি বছর লালপুরে ৫ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রামে ১ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুরে ১ হাজার ৩২ মেট্রিক টন, নাটোর সদরে ৫৯৮ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গায় ৯১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন, সিংড়ায় ৭৬৫ মেট্রিক টন এবং বাগাতিপাড়া উপজেলায় ৩৪৪ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হয়।
স্থানীয়রা জানান, চিরায়ত বাংলার প্রচীন এক ঐতিহ্য খেজুরের গুড়। শীতের ভোরে গ্রামীণ জনপদে খেজুরের রস সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়েন কৃষকেরা। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য্য উকি দেওয়ার আগেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি মটির চুলায় সেই রস জ্বাল করে গুড় তৈরির কাজ শুরু হয়। রস থেকে নানা ধরণের পাটালী এবং ঝোলা গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে।
গুরুদাসপুরের সরকারি বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের কৃষি বিভাগের শিক্ষক জহুরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, দেশজুড়ে খেজুরের রস এবং গুড়ের আলাদা খ্যাতি রয়েছে। অথচ চাহিদা পূরণে খেজুরের গাছ রোপনের মাধ্যমে গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কেবলমাত্র শীত পড়লেই সামনে আসে খেজুর গাছের কথা। সুস্বাদু খেজুরের গুড় গুরুত্বপূর্ণ মিষ্টান্নর চাহিদা পূরণ করলেও এই গুড় বাণিজ্যিকরণে ব্যাপকভাবে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না কৃষি অফিসের।
শিক্ষক নাছরিন সুলতা ইত্তেফাককে বলেন, নাটোরে বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের গাছ রোপণের কোনো নজির নেই। প্রাকৃতিকভাবে ঝোঁপ-ঝাড়ে অযত্নে বেড়ে উঠা গাছগুলোই সুস্বাদু খেজুরের গুড়ের চাহিদা পূরণ করে। শুধু রস আর গুড়েই শেষ নয়। খেজুর গাছের পাতা এবং কাঠের রয়েছে নানবিদ ব্যবহার।
গাছিরা জানান, একজন গাছি প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করেন। একজন গাছি শীত মৌসুমে ৭০ থেকে ৭৫ দিনে একটি খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন।
গুরুদাসপুরের গাছি আকবর আলী, লালপুরের খলিলুর রহমানসহ পাঁচ উপজেলার অন্তত ৫০ জন কৃষক ইত্তেফাককে জানান, গাছিরা রস সংগ্রহ করে নিজেরাই গুড় তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করেন। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হন। বিশেষ করে গুরুদাসপুরে উৎপাদিত গুড় দেশের সনামধন্য কয়েকটি কোম্পানি এবং বিদেশে বাজারজাত করা হয়। তবে খেজুরগুড় উৎপান এবং বিপনন সংক্রান্ত তেমন কোনো সরকারি সহায়তা পান না তারা।
গাছি সফিউল্লাহ, আবুল কালাম, আব্দুল মজিদ জানান, খেজুরের গুড়ের মওসুম শুরু হলেই একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চিনি মিশিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করেন। তাছাড়া দীর্ঘদিনের পচা পাটালি এবং ঝোলাগুড় মিশিয়েও গুড় তৈরি করা হয়। এতে করে খাঁটি গুড়ের চাহিদা ব্যপাকভাবে কমে যায়। তারা চলতি মওসুমে ভেজাল গুড় ব্যবসায়ীদের প্রশাসনের নজরদারি দাবি করেন।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ ইত্তেফাককে বলেন, শীত নামার আগই গাছিরা রস সংগ্রহ করে গুড় উৎপাদন শুরু করে দিয়েছেন। খেজুরের উৎপদন এবং বিপণনের বিষয়ে তারা কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা ভেজাল গুড় উৎপাদন এবং বিপণনের বিষয়ে ব্যাপক নজরদারির কথাও জানান তিনি।